বঙ্গোপসাগরের উত্তরে মেঘনা নদীতে অবস্থিত মনপুরা দ্বীপ (৩৭৩ বর্গ কি.মি.)। হাতিয়া আর ভোলার মতো বড় আর ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপগুলো ঘিরে রয়েছে তাকে।
মনপুরাতে যাবার পথে চোখে পড়বে নতুন গজিয়ে ওঠা দ্বীপ, যাকে দেখে প্রথমটায় আমরা মনপুরা ভেবেছিলাম। সেখানটায় এলোপাথাড়ি গাছপালা ছাড়া মানববসতির কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। মনপুরার তীরেও অনেকটা তা-ই। ছাড়া ছাড়া গাছপালা ছিল, আর ছিল চড়ে বেড়ানো গবাদী পশু। বাড়ি ঘর কিছুই ট্রলার থেকে দেখবার উপায় নেই। এর কারণ পাড়ের অতিরিক্ত ভাঙন। পুরো দ্বীপের পাড়গুলো ভেঙেচুরে ভয়ানক রূপ ধারণ করে রেখেছে।
আগেই বলে রাখি, এই মনপুরাতে আপনি যদি বিশেষ কোনো একটা বা দুটা জায়গা দেখবার উদ্দেশ্যে যান, তবে এ ভ্রমন বৃথা হবে।
বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ পর্যটন খাতের ক্ষেত্রে যে উদাসীন, এ কথা তো মানতেই হবে। ঠিক সেকারণেই কেন্দ্রীয় নগর থেকে এত দূরে, বৈদেশিক বা দেশীয় কোনোরকম লেনদেনের কাজে ব্যবহার না হওয়া এই অনুন্নত মনপুরা দ্বীপে বিশেষ কোনো জায়গা দেখে আপনার মন ভরবে না। আপনি যদি গ্রাম প্রেমিক হন, এমনি এমনি প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান, শহুরে যান্ত্রিকতায় হাঁপিয়ে ওঠেন বা আপনার বুকের কোনো এক কোণে বিভূতিভূষণকে লালন করেন, তাহলে মনপুুরা-ই আপনার কাঙ্ক্ষিত জায়গা!
প্রায় পুরো দ্বীপটাতেই মেঠো রাস্তা; রাস্তা পাকা হয়েছে কদাচিৎ। ঘাট থেকে কিছুদূর শহুরে জঞ্জাল। গ্রামের এলাকাটায় ঢুকলেই রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায়, শুধু বিল আর ধানক্ষেত।
মনপুরা দ্বীপটা বরিশাল এলাকায় পড়ে। আর বরিশালের একটা বিশেষত্ব হল, টিনশেডের দোতলা বাড়ি। আর এই বিশেষ ব্যাপারটা মনপুরায় ছিল ভরপুর। রাস্তার দুপাশে যতগুলো বাড়ি দেখেছি, তার ৯৫ ভাগ বাড়িই ছিল দোতলা। কিন্তু পাকা বাড়ি একটিও নয়। বাড়িগুলোর নিচের অংশটা বড়, উপরের অংশটা তুলনামূলক ছোট। কিছু বাড়ি ছিল সাদামাটা। আবার কিছু বাড়ির গঠনশৈলী ছিল বেশ কারুকার্যে ভরা, আর রঙিন।
এখানে পুকুর দেখতে দেখতে আপনি অতিষ্ট হবেন না বটে, কিন্তু অবাক হবেন। প্রতিটা বাড়িতে আলাদা আলাদা পুকুর। আর পুকুরের সাথে পাল্লা দিয়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাঁসের পাল৷ রাজ হাস, পাতি হাস, আর ভিন্ন জাতের মুরগি।
আপনি দ্বীপের যত ভেতরে যেতে থাকবেন, ততই কম মানুষ দেখতে থাকবেন। শুধু প্রকৃতি তার নিজের রূপ ঢেলে বিছিয়ে রেখেছে; অচেনা শুরে গান শুনিয়ে চলেছে।
এ যে কতকাল ধরে, কত আস্তে আস্তে নিজেকে এমন সমৃদ্ধ করেছে, ভাবলেও অবাক লাগে। এই ভাবনার কারণ, ট্রলারে করে আসার পথে নতুন গজানো চর দেখেছি বেশ কয়েকটা। পানির উপর অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বালিরাশির মতো কিছু একটা। সে যা-ই হোক, অন্তত লোক বসতির যোগ্য কিছু বলে মনে হয়নি। অথচ এই থেকেই শুরুটা হয়। গাছ হয়, ঘর করে, নতুন জীবনযাত্রা শুরু হয়! শুনেছি এই মনপুরাতেও শুরুতে জনবসতি ছিল না। ধু ধু প্রান্তর ছিল মানববিহীন। দ্বীপটার যত ভেতরে গেলাম, তার চিহ্নই পেলাম।
চারাবাগান নামের জায়গাটাতে অবশ্যই যাবেন। এটা আবশ্যক। মৎস্য প্রজেক্ট বলে পরিচিত জায়গাটা। ঘাট থেকে বেশখানিকটা দূরে।
এখানে কী পাবেন?
আবারও আপনাকে হতাশ করে দিয়ে বলছি, এখানে শুধুই গাছপালা আর খাল দেখতে পাবেন। আর কিছু নেই।
এবার আমার দৃষ্টি থেকে বলি। একটা স্বর্গীয় রাস্তা ঠিক যেমনটা আমার চোখে ভাসে, এটা তা-ই। একটা মাটির রাস্তা। মনপুরার অন্যান্য রাস্তার মতো এবড়োথেবড়ো না, সমান মসৃণ; একেবেঁকে চলে গেছে। দুপাশে ঘন করে গাছ। রাস্তাটায় গাছের শুকনো পাতা আর ছায়ার কারুকাজ। দৃষ্টি দূরে মেলে দিলে মনে হবে রাস্তাটার শেষপ্রান্তে গিয়ে গাছগুলো মিলে গেছে। কিন্তু আদতে সেটা বাঁকানো রাস্তার কারসাজি। রাস্তার পাশে চিকন খাল, আর ক্ষেত। আমরা যখন ছিলাম, গরু ছাগল আর ভেড়ারা আপন মনে চড়ে বেড়াচ্ছিল; কিন্তু কোনো মানুষ ছিল না।
ফেরার সময় আমরা ফিরেছি বেরি-বাঁধের রাস্তাটা দিয়ে। কোথাও রাস্তার পাশেই নদী, আবার কোথাও ক্ষেত, তারপর নদী। মাইলের পর মাইল বাঁক নিয়ে চলে গেছে অপূর্ব সুন্দর রাস্তাগুলো। এখানেই আমদের গাড়ি-চালকের অসাবধানতার কারণে এবড়োথেবড়ো রাস্তার ধাক্কায় গাড়ি কাত হয়ে নদীতে পড়বার উপক্রম হয়েছিল। আর সেই উছিলাতেই এক সুন্দর বাঁকে নামতে পেরেছিলাম, যেখানে নদীর পানি রাঙিয়ে অস্তগামী সূর্যের বিদায়ের আসর দেখতে পেরেছিলাম শান্তিমতো।
ভেতরটা ঘুরে আবার যখন বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন অদ্ভুত ধরণের দালান চোখে পড়েছে। দালানগুলো দোতলা। কিন্তু নিচতলায় কিছু নেই, পিলার ছাড়া। এই দালানগুলোর কোনোটায় লিখা হাসপাতাল, কোনোটায় স্কুল। এগুলো এভাবে তৈরির কারণ এখানকার আবহাওয়া। বন্যা এলে বা ভয়ানক কোনো দুর্যোগে এগুলোই হয়ে ওঠে এলাকার মানুষগুলোর আশ্রয়কেন্দ্র।
আমরা আরেকটা জায়গা ঘুরেছিলাম৷ দক্ষিণা হাওয়া সৈকত। এটা যেকোনো সাধারণ সৈকত বৈ কিছু না৷ আমাদের বলা হয়েছিল, এটাই আমাদের এত লম্বা জার্নির বিশেষ আকর্ষণ। আমার কাছে এমন বিশেষ কিছু লাগেনি। অন্তত সারাটাজীবন চট্টগ্রামে কাটিয়ে তো না-ই। বরং গাড়িতে চড়া অবস্থায় দেখা প্রতিটা জিনিস আমার কাছে নতুন আর বিশেষ ছিল।
যাওয়ার উপায় কী?
আমরা চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে এম. ভি. তাজুদ্দিন জাহাজে করে রওনা হয়েছি। গিয়েছি ভিআইপি কেবিনে করে, কেবিন প্রতি ভাড়া ৩১০০। একেক কেবিনের সেমি-ডবল খাটে চেপেচুপে ৩জন ঘুমোতে পারবে। আর শীতের দিনে এ যে কী আরাম, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না!
কেবিনে লাগোয়া বাথরুম ছাড়াও ছিল আলমারি, টেবিল, চেয়ার, আয়না আর বেলকনির বাইরের দারুণ সূর্যোদয় দেখার মতো একটা বড়সড় জানালা।
এছাড়া সেকেন্ড ক্লাস কিংবা থার্ড ক্লাসের টিকেট করেও যাওয়া যাবে। সেক্ষত্রে ভাড়া যথাক্রমে ১৩০০ ও ৩৫০ টাকা।
জাহাজ সকাল ৯টায় ছেড়ে হাতিয়া পৌঁছাতে দুপুর ২টা বেজেছে। তাই সেই দিনটা বাদ দিয়ে পরদিন সকাল ৮ টায় মনপুরার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি ট্রলারে করে। আরো সকালে রওনা দিতে পারলে আরো ভাল।
যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। মাঝারি ট্রলার রিজার্ভ নিলে ৬০০০ টাকা পড়বে। এছাড়া ভোলা থেকে গেলে সরাসরি লঞ্চে করে মনপুরা যেতে পারবেন।
নামার পর আমরা টমটম গাড়িগুলো দ্বীপ ঘুরিয়ে দেখার জন্য ভাড়া করেছি ৬০০ করে। চাইলে বাইকে করেও ঘুরে দেখা যাবে। সেক্ষেত্রে এক বাইকে দুজন বসতে পারবে। বাইকপ্রতি খরচ ৬০০ টাকা।
দ্বীপ ভ্রমণ শুরু করবার আগেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিলে ভাল৷ দোকান-পাট, হাসপাতাল বা অন্য যেকোনো কিছুর প্রয়োজন থাকলে ঘাটে নেমেই সেরে নিতে হবে। নাহয় ভেতরে গেলে এমন কিছু আর পাওয়া যাবে না।
দ্বীপ ঘুরে ঠিক সূর্যাস্তের সময়ই আমরা ফেরার জন্য ট্রলারে উঠেছি। নয়তো কুয়াশার কারণে রাস্তা ভুল করা বা অন্য প্রতিকূলতার সম্ভাবনা থেকে যেতো। সেই একই পথ ধরে ৩ ঘণ্টার ক্লান্তিকর হাড় কাঁপানো শীত ঠেলে হাতিয়াতে থেমে থাকা জাহাজটাতে পৌঁছালাম।
এখানে লক্ষ্যনীয়, এই ২য় রাতটাও আমরা জাহাজে কাটিয়েছি। ৩ দিনের জন্য ছিল আমাদের জাহাজ ভ্রমন।
সাধারণ যাত্রীদের ক্ষেত্রে রাতে জাহাজে থাকার ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। আর না হলে একটা রাত হাতিয়া দ্বীপে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা মনপুরাতে যে হোটেলের ব্যবস্থা আছে, সেখানে পৌঁছেও রাত কাটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।
এই তাজউদ্দীন জাহাজটা হাতিয়াতে বৃহষ্পতি-শুক্র-শনিবারের ট্রিপ হিসেবে যায়। দু’রাত থেমে থাকার পর শনিবারে জাহাজভর্তি যাত্রী নিয়ে আবার চট্টগ্রাম ফিরে আসে।
সবশেষে এটুকুই বলব, ভ্রমণ হোক পরিবেশ-বান্ধব। আপনার পদচিহ্ন, ভাল সম্পর্ক থেকে যাক স্মৃতি হিসেবে, প্লাস্টিক আর ময়লা আবর্জনা নয়।