নারী ও পুরুষ উভয়েই বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুকির সম্মুখীন হয়। তবে কিছু নির্দিষ্ট অসুস্থতা এবং ব্যাধি রয়েছে যা হয় পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বেশি প্রভাবিত করে বা যা শুধুমাত্র জৈবিক কারণে মহিলাদের প্রভাবিত করতে পারে।
মহিলাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে জীবনও বদলে যায়। শরীরে অনেক বড় পরিবর্তন আসে। নারীদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি দেখা দেয়। শরীর হঠাৎ হঠাৎ গরম হয়ে যায়, ঘুম কমে যায়, দুর্বলতা অনুভব করে। তাছাড়া পরিবারের দায়িত্ব পালনের কারণেও নারীর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে।
এখানে আমরা বয়স বাড়লে মেয়েদের যেসব স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়, এর কারণ, লক্ষণ এবং চিকিত্সা কী এবং প্রতিরোধের জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করব।
স্তন ক্যান্সার
চিকিৎসকেরা বলছেন, স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে, ওই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়। সেটি রক্তনালীর লসিকা (কোষ-রস) ও অন্যান্য মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাই ক্যান্সার।
স্তন ক্যান্সার মহিলাদের মধ্যে ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ রূপ, এবং এটি মহিলাদের জন্য ক্যান্সারের মধ্যে মৃত্যুর প্রধান কারণ। এটি সমস্ত মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি বলেছে যে একজন মহিলার জীবদ্দশায় স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আটজনের মধ্যে এক, তবে ACS তারা হতাশাবাদী হওয়ার চেয়ে বেশি আশাবাদী, উল্লেখ্য যে এটির অর্থ হল একজন মহিলার আটজনের মধ্যে সাতজনের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি বিকাশ করবে না।
স্তন ক্যান্সার যদি প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে পুরোপুরি এর নিরাময় সম্ভব। আর সেজন্য বাড়িতে বসেই নিজের স্তন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা । ২০ বছর বয়স থেকেই নিজে নিজে স্তন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
আরও পড়ুন: স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে এই ৯ টি তথ্য আপনি জানেন কি?
ডায়াবেটিস
যখন শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করে না বা এটি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না, তখন ডায়াবেটিস বলে।
ডায়াবেটিস এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, যা বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রায় প্রত্যেক মানুষকেই প্রভাবিত করে। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস যে মাঝেমাঝেই আলাদা রূপে দেখা দেয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রজননক্ষম রোগীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হচ্ছেন নারী। গর্ভকালীন ২ থেকে ৫ শতাংশ নারী ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। ৪০ বছরের বেশি বয়সের মহিলাদের অন্যতম প্রধান রোগ হল ডায়াবেটিস, যা অন্ধত্ব, কিডনিজনিত রোগ এবং স্নায়ুজনিত রোগ সহ আরও অনেক গুরুতর সমস্যার জটিলতা বাড়িয়ে তোলে।
মহিলাদের মধ্যে ক্ষতির আশংকা বাড়ার কয়েকটি কারণ হল নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস না মেনে চলা এবং জীবনযাত্রার কোনওরকম পরিবর্তন না করেই ওষুধ খাওয়া। ডায়াবেটিস ৪০ বছরের বেশি বয়সী মহিলাদেরকে প্রভাবিত করে, এই অবস্থার মূল চিকিৎসা হল যথাযথ ব্যায়াম করা এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করা, নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করা, ধূমপান থেকে বিরত থাকা। সুষম খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখাই সবচেয়ে ফলপ্রসু।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস কি? ডায়াবেটিস এর কারন কি? ডায়াবেটিস এর লক্ষণ কি?
আর্থ্রাইটিস বা বাত
এই রোগ বিশেষত বয়স্ক মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়I । সাধারণত অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টের প্রদাহকেই আর্থ্রাইটিস বলা হয়। এটি সন্ধিবাত নামেও পরিচিত। আর্থরাইটিস বা বাত এর ব্যাথা কোনো একক রোগ নয় বরং হাড়ের জয়েন্ট সম্পর্কিত যে কোনো ব্যাথা বা রোগ কেই আর্থরাইটিস বলা হয়I
বয়স না বাড়তেই বেশির ভাগ নারী কোমরব্যথা, হাঁটুব্যথা, কবজিব্যথাসহ নানা রকম ব্যথায় আক্রান্ত হন। নারীরা মধ্যবয়স থেকেই ওজন বৃদ্ধির সমস্যায় পড়েন। যাদের ওজন বেশি, অস্টিওআর্থ্রাইটিস তাদের বেশি হয়। সাধারণ স্থূল শরীরের মানুষের হাঁটুতে রোগটি বেশি দেখা দেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে দেখা যায়।
সাধারণত মেয়েরা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-র অভাবে ভোগে। আর এই দুটো জিনিস হাড়ের সুস্থতায় খুবই জরুরি। আর ব্যায়াম ও খেলাধুলাতেও মেয়েরা অনেক পিছিয়ে। তাই অস্থিসন্ধি সুস্থ রাখতে কম বয়স থেকেই নারীদের সচেতন হতে হবে।
হৃদরোগ
প্রধানত হৃদসংবহন তন্ত্র, মস্তিষ্ক, বুক ও প্রান্তিক ধমনীর সম্পর্কিত রোগকে হৃদরোগ বলা হয়। হৃৎপিন্ড তার কাজ ঠিকমতো করতে না পারাকেই হার্ট ফেইলুর বলা হয় যা সহজভাবে হার্ট ফেল নামে পরিচিত। হার্টের যে স্বাভাবিক গতি সেটা কম বা বেশি হলেই মানুষ সাধারণত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়।
ধূমপান হৃদরোগের অন্যতম কারণ। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শুধু পুরুষরাই নন, মহিলাদেরও হার্ট অ্যাটাকের ঝুকি রয়েছে একইভাবে। বংশগত কারণ ছাড়াও অনিয়মিত জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ভুল ডায়েট, দুশ্চিন্তা ইত্যাদি নানা কারণে হৃদরোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের উপসর্গগুলি কিন্তু পুরুষদের তুলনায় আলাদা। দ্রুত গতিতে হৃদস্পন্দন, হাতের উপরের দিকে এবং পিঠে ব্যথা, অবসন্ন লাগা, ক্লান্তিবোধ হওয়া, অল্পেতেই হাঁপিয়ে ওঠা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে ঘাম বেরোনো হার্ট ফেলের উপসর্গ।
হার্ট ভালো রাখতে অনিয়মিত লাইফ স্টাইল বন্ধ করতে হবে, ধূমপান, মদ্যপান বন্ধ করতে হবে। প র্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত শরীর চর্চা, ডায়েট মেনে খাবার খাওয়া, লবণ ও চিনি কম খেলে হৃদপিণ্ড সুস্থ্য থাকবে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুকি একেবারেই কমে যাবে।
আরও পড়ুন: হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের ১০টি লক্ষণ
ডিমেনশিয়া
ডিমেনশিয়া একটি ল্যাটিন শব্দ demantare থেকে এসেছে, এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘পাগল করে দেয়া’। এটি মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট রোগ। ডিমেনশিয়া একটি বিস্তৃত শব্দ যা রোগ, ট্রমা বা অন্যথায় স্মৃতিশক্তি হ্রাসের যে কোনো রূপকে বর্ণনা করে।
ডিমেনশিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল আলঝেইমার। এটি এক ধরণের মানসিক রোগ। বিভিন্ন রোগের কারণে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভংশ রোগ হতে পারে।যেমনঃ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, আলঝেইমার, এইডস, থাইরয়েডের সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি ধূমপান বা মদ্যপান, ভিটামিন বি এর অভাব, শরীরে ভিটামিন বা খনিজের ঘাটতি, কার্বন মনোঅক্সাইড বিষক্রিয়া, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যাওয়া এবং মস্তিষ্কের নানা রোগ। স্মৃতিশক্তি কমতে থাকা, বিশেষ করে সল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তি কমতে থাকা এ রোগের প্রধান লক্ষন।
দুর্ভাগ্যবশত, ডিমেনশিয়ার কোন প্রতিকার নেই। রোগ নির্ণয় এবং রোগ শুরু হওয়ার কারণের উপরও চিকিৎসা নির্ভর করে। নিয়মিত শরীর চর্চা ও মানসিক ব্যয়াম, সুষম খাদ্য গ্রহন এবং জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনলে ডিমেনশিয়াকে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করা যায়।
বিষণ্ণতা
বিষণ্নতা আলঝাইমার রোগ । বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীদের মধ্যে হতাশা আর উদ্বেগ দেখা দেয়। শরীরে হরমোন ওঠানামার জন্য হতাশা বা উদ্বেগ সৃষ্টি হতে পারে। পেরিমেনোপজ এবং মেনোপজের পরিবর্তনগুলো হতাশার কারণ হতে পারে। যে কোনো জায়গায় ১০-২৫ শতাংশ নারী তাদের জীবনে বিষণ্নতায় ভোগেন।
বিষণ্ণতা প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অফ ওটাওয়ার গবেষক ইয়ান কলম্যান জানিয়েছেন যে, একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বেশিরভাগ মহিলারই মৃত্যু হয়েছে বিষণ্ণতার কারণে। সমীক্ষায় আরও দেখা গিয়েছে যে, ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মহিলারা বেশি বিষণ্ণতায় ভোগেন।
এক্ষোত্রে থেরাপিস্ট এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্ষ নেওয়া উচিত। বিষণ্ণতার লক্ষণগুলি এবং আপনি কেমন অনুভব করছেন সে সম্পর্কে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন এবং তিনি আপনাকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে পারেন। যদিও এদেশের প্রেক্ষাপটে খুব কম মানুষই মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের শরনাপন্ন হয়, যার ফলে অনেক ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়।